বৃহস্পতিবার, ১১ জুন, ২০১৫
লাবু এলো শহরে - মুহম্মদ জাফর ইকবাল
মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের সাম্প্রতিক সময়ে রচিত উপন্যাসগুলোর যে প্রধান বৈশিষ্ট্য তা হল, সেগুলোতে তাঁরই ইতিপূর্বে লেখা বিভিন্ন উপন্যাসের ছোটখাট অনেক বিষয়বস্তুর বেশ ভালো রকমের ছায়া বা প্রভাব দেখা যায়। 'লাবু এলো শহরে' উপন্যাসের ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছে। তারপরও উপন্যাসটি আমার কাছে বেশ ভালোই লেগেছে। কারণ অতি চেনা ফরমুলায় লেখা এই উপন্যাসেও কিছু নতুনত্ব আছে, নভেলটি আছে, ইমোশন আছে, মানবিকতা আছে, অ্যাডভেঞ্চার আছে আবার সমাজ সচেতনতার বিষয়ও আছে।
'লাবু এলো শহরে' নাম থেকেই বোঝা যায় লাবু এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র যার গ্রাম থেকে শহরে এসে শহুরে জীবনের সাথে মানিয়ে নেবার লড়াইয়ের কাহিনী এটা। তবে নাম থেকে করা অনুমানের সাথে বাস্তবের কাহিনীর কিছুটা ভিন্নতা আছে।
লাবুই এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র তবে সে গ্রামে নয়, বাস করত জঙ্গলে! ছোটবেলায় তার মা মারা যাবার পর তার বাবা তকে নিয়ে চলে আসেন এক জঙ্গলে এবং সেখানেই লাবুকে তিনি বস করতে শুরু করেন। জনমানুষের চিহ্নবিহীন সেই জঙ্গলে লাবু নিজের মত করে বড় হতে থাকে বন্য পরিবেশে, বন্য পশুপাখির সাথে মিলেমিশে। ঠিক যেন টারজানের মত! কিন্তু এক সময় লাবুর ঝুমু খালা আসে আর জোর করে এবং কিছুটা ছলনার (!) আশ্রয় নিয়ে লাবু আর তার বাবাকে নিয়ে যান ঢাকা শহরে। সেখানে শহুরে জনজীবনের সাথে মানিয়ে নেবার ও নতুন বন্ধুদের সাথে মিশে 'সামাজিক' হবার সংগ্রামে নামতে হয় লাবুকে।
কিভাবে লাবু এই সংগ্রামে জয়ী হয় কিংবা আদৌ জয়ী হয় কিনা, তা জানতে পড়তে হবে এই বইটি। এবং তার বর্ণনা স্যার যেভাবে তুলে ধরেছেন তা এক কথায় অসাধারণ। প্রতিটা দৃশ্য আর প্রতিটা ঘটনায় হিউমারের ছড়াছড়ি। তবে লাবুর শহুরে জীবনে মানিয়ে নেয়া বা সামাজিক হয়ে ওঠাতেই কিন্তু এই বইয়ের কাহিনীর পরিসমাপ্তি নয়।
এরপর নির্দিষ্ট কোন ছকে স্যার কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যান নি। তবে নিয়ে এসেছেন এক মুক্তিযোদ্ধার কথা যিনি বর্তমানে ঢাকা শহরের এক সামান্য রিকশাওয়ালা। সেই মুক্তিযোদ্ধার মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনিয়েছেন তাঁরই মুখ থেকে। সেই গল্প সত্যিই অনবদ্য। আর সেই মুক্তিযোদ্ধার স্বাধীন দেশে বর্তমান অবস্থানের যে চিত্র স্যার দেখিয়েছেন, তা পড়ার পর যে কারোই চোখ ভিজে উঠতে বাধ্য। কিন্তু তা একেবারেই কোন কল্পকথা নয়। প্রকৃত বাস্তবতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন স্যার।
পরবর্তিতে লাবুকে দেখা যায় বাবার সাথে সিলেটের চা বাগানে যেতে। সেই চা বাগানের প্রেক্ষাপটে স্যার তুলে ধরেছেন চা শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র। শোষক শ্রেণির মুখোশও খুলে দিয়েছেন তিনি। তুলে ধরেছেন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা। আর এই সবই স্যার করেছেন লাবু চরিত্রের মাধ্যমে। আর তাই শুরুতে লাবু চরিত্রের ছেলেটার যে কাহিনীকে নিছকই হাসিঠাট্টার বিষয় মনে হচ্ছিল, ক্রমেই তা সিরিয়াস হয়ে ওঠে। এবং শেষ পর্যন্ত 'লাবু এলো শহরে' পরিণত হয় দারুণ এক মর্মস্পর্শী কিশোর উপন্যাসে। কিন্তু এর শেষ ভাগের সিরিয়াস বিষয়বস্তু যে শুধু কিশোরদের মনেই সচেতন্র বীজ বপন করবে, তা না। বড়দেরও বিবেকবোধ জাগ্রত করবে। সেজন্য ছোট বড় সবার জন্যই 'লাবু এলো শহরে' হতে পারে আদর্শ একটি উপন্যাস।
0 Responses to “লাবু এলো শহরে - মুহম্মদ জাফর ইকবাল”
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন