বৃহস্পতিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৬
জোছনা ও জননীর গল্প - হুমায়ূন আহমেদ
একজন মানুষের তার দেশের প্রতি, দেশ মাতৃকার প্রতি তার জন্মের ঋণ শোধ করার সাথে একজন লেখকের শোধ করার পার্থক্য কি খুব বেশি? সামাজিক দায়বদ্ধতা বলে যে গুরুগম্ভীর শব্দটা আমরা হরহামেশাই শুনি সেই দায়বদ্ধতাটা লেখক হিসেবে কিভাবে পুরন করবেন একজন লেখক? মানুষের যেমন পিতৃঋণ-মাতৃঋণ শোধ করতে হয়, দেশমাতার ঋণও শোধ করতে হয়। হুমায়ূন আহমেদের কাছে একজন লেখক হিসেবে সে ঋণ শোধ করা যায় লেখার মাধ্যমে। আর দেশ দেশ মাতৃকার প্রতি একজন লেখক হুমায়ুন আহমেদের যে ঋণ তা শোধ করার মাধ্যম হসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন ‘জোছনা ও জননীর গল্প’কে। ভূমিকাতেই হুমায়ূন আহমেদ পরিস্কার করে বলে দিয়েছেন যে ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ কোন ইতিহাসের বই না কিন্তু এটা এমন একটা উপন্যাস যে উপন্যাসের কাহিনীকে সাজানো হয়েছে দেশ মাতার ঋণ শোধ করার জন্য। একজন লেখক হিসেবে লেখাকে পন্য বানানোর জন্য নয়, একজন লেখক হিসেবে মানুষের সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে বইয়ের পসারের জন্য তিনি এ উপন্যাসটি লেখেন নি। তাই উপন্যাস হলেও হুমায়ূন চেষ্টা করেছে ইতিহাসের একেবারে কাছাকাছি থাকার। সে অর্থে ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ আমার মতে উপন্যসে আদলে গড়া ইতিহাসের দলিল। যে সে ইতিহাসের নয়, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের দলিল। ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ এর শুরুটা ফাল্গুন মাসের শুরুতে, তার মানে ১৯৭১ এর ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি সময়ে যখন নীলগঞ্জ হাইস্কুলের আরবী শিক্ষক মাওলানা ইরতাজউদ্দিন কাশেমপুরীর ছোটভাই শাহেদ, ভাইয়ের বউ আসমানী আর ভিয়ের মেয়ে রুনিকে দেখতে ঢাকা আসে। এই মাওলানা ইরতাজউদ্দিন, শাহেদ, আসমানী আর তাদের ঘিরে থাকা মানুষজনদের নিয়ে ‘জোছনা ও জননীর গল্প’। এত বড় একটা উপন্যাসের চরিত্র চিত্রন করা খুব কঠিন কাজ। যে বিষয়টি এই উপন্যাসে চরিত্র চিত্রনে আমার খুব ভালো লেগেছে তা হল প্রতিটি চরিত্রের পরিপুর্নতা। এত বড় উপন্যাস হিসেবে এর প্রধান প্রধান চরিত্রের নয়মাসকাল সময়ের উত্থান-পতন যেন ভূমিকায় লেখা হুমায়ূন আহমেদের সেই লেখাটাই মনে করিয়ে দেয়ঃ ‘সে বড় অদ্ভুত সময় ছিল। সপ্ন ও দুঃসপ্নের মিশ্র এক জগত। সবই বাস্তব, আবার সবই অবাস্তব।’ তাইতো মনটা আপ্লুত হয়ে উঠে যখন মাওলানা ইরতাজউদ্দিন বলে উঠে ‘যা বলতেছি চিন্তাভাবনা করে বলতেছি। এখন থেকে আমি জুম্মার নামাজ পড়ব না। পরাধীন দেশে জুম্মার নামাজ হয় না। নবী-এ-করিম যতদিন মক্কায় ছিলেন জুম্মার নামাজ পড়েন নাই।’(পৃষ্ঠাঃ ৩৮০)। পাকিসাত্নীদের প্রতি ঘৃণায় রিরি করে উঠে আমাদের শরীর যখন দেখি নামাজ না পড়ানোর অপারধে মাওলানা সাহেবকে উলঙ্গ করে নীলগঞ্জ বাজারে চক্কর দেয়ানো হয়। তারপর তাকে সোহাগী নদীর পাড়ে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। তারপরের ঘটোনায় আমরা আশ্চর্যান্নিত হয়ে যাই। ‘নীলগঞ্জের মানুষ বিস্ময়ের সঙ্গে দেখল, হেডমাষ্টার সাহেবের সঙ্গে ঘোমটা পরা একজন মহিলা প্রবল বর্ষনের মধ্যে মাওলানা ইরতাজউদ্দিনের বিশাল শরীর টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। তাদের খুব কষ্ট হচ্ছে। অনেকেই দৃশ্যটা দেখছে, কেউ এগিয়ে আসছে না। হটাত একজনকে ভিজতে ভিজতে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। সে আসিয়া বেগমের কাছে এসে উর্দুতে বলল, মাতাজি আপনি সরুন, আমি ধরছি। মনসুর সাহেব বললেন, আপনার নাম? আগন্তুক বলল, আমি বেলুচ রেজিমেন্টের একজন সেপাই। আমার নাম আসলাম খাঁ।’ এটাই তো যুদ্ধ। সে বড় অদ্ভুত সময় ছিল। শাহেদের গল্পটা কি ভিন্ন কিছু। নিজের স্ত্রী সন্তানকে হারিয়ে তাদের খুজে ফেরার কি নিদারুন কাহিনী। শাহেদ যেন যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের সকল বাবাদের প্রতিনিধি, সকল প্রেমময় স্বামীদের প্রতিনিধি। যে যুদ্ধা যায় নি কিন্রু এ মাথা, ও মাথা চষে ফেলেছে মেয়ে আর বউকে পাওয়ার জন্য। রাস্তায় রাস্তায় তল্লাশী, মিথ্যা কথা বলা, কোন এক পাকিস্তানীর দাক্ষিন্য, কোনটা বাদ যায় না। জিজ্ঞাসাবাদ চলে। কেউ হয়তো ছাড়া পাবে, কেউ পাবে না। একটা কথায় যেন পুরো সময়টা ধরে রাখা হয়েছে ‘অনিশ্চয়তা। The day and night of uncertainty. (পৃষ্ঠাঃ ৩৫৭)’ কিংবা কংকনের গল্প। কংকনের সাথে লেখকের পরিচয় আমেরিকায়। সেখান থেকেই হয়তোবা লেখক শাহেদকে চিত্রিত করেছে। কোন একসময় যুদ্ধের সেই ‘অনিশ্চয়তা’র মধ্যে কংকনকে খুজে পায় শাহেদ। তারপর থেকে কংকনকে নিয়ে তার উদবাস্তু শিবিরে যাওয়ার পথ মৌসুমী ভৌমিকের ‘যশোর রোডের’ কথা মনে করিয়ে দেয়। কংকন তাও তার বাবা-মাকে খুজে পেয়েছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ তো এমন অনেক কংকনের জন্ম দিয়েছে যারা আর তাদের বাবা-মাকে খুজে পায়নি। শাহেদ তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী-সন্তানকে খুজে পেয়েছে কিন্তু এমন ভাগ্য কজনের হয়েছে এই বাংলাদেশের জন্ম হতে গিয়ে। তাইতো লেখকের সামনে ‘রোরুদ্যমান তরুনীর দিকে তাকিয়ে হটাত আমার মনে হলো, কংকন কাঁদছে না। কাঁদছে আমাদের বাংলাদেশ। আমাদের জননী। (পৃষ্ঠাঃ ৩৬১)’। মরিয়মের ভাগ্য কিন্তু ওরকম হয়নি। বিয়ের পরপরই স্বামী নাইমুল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। বাংলার চিরন্তন বধুর মতই নিজের বিপদের কথা চিন্তা না করে স্বামীর ভালোর চিন্তা করেছে। স্বামীকে চিঠি লিখেছে, জানে সে চিঠি পৌছুবে না কিন্তু কি লিখেছে ‘তুমি ভালো থেকো। শরীরের যত্ন নিও। বেশি সাহস দেখানোর দরকার নেই। অন্যরা সাহস দেখাক, তোমাকে সাহস দেখাতে হবে না।.......... আচ্ছা শোন, রাতে ঘুমুতে যাবার আগে আয়াতুল কুড়শি পড়ে তিনবার হাততালি দিয়ে ঘুমুতে যাবে। তালির শব্দ যতদুর যায় ততদুর পর্যন্ত কোনো বালামুসিবত আসতে পারে না। আমরা সবসময় তাই করি। (পৃষ্ঠাঃ ২২১)।’ আমরা হাউমাউ করে কেদে উঠি যখন মরিয়মের ক্ষেত্রে ‘বাস্তবের সমাপ্তি এরকম ছিল না। নাইমুল কথা রাখেনি। সে ফিরে আসতে পারেনি তার স্ত্রীর কাছে। বাংলার বিশাল প্রান্তরের কোথাও তার কবর হয়েছে। কেউ জানে না কোথায়। এ দেশের ঠিকানাবিহীন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার কবরের মধ্যে তারটাও আছে। তাতে কিছু যায় আসে না। বাংলার মাটি পরম আদরে তার বীর সন্তানকে ধারন করেছে। জোসনার রাতে সে তার বীর সন্তানদের কবরের অপুর্ব নকশা তৈরি করে। গভীর বেদনায় বলে, আহারে! আহারে! (পৃষ্ঠাঃ ৫০৫)’ একটা দুটো বা তিনটি চরিত্র দিয়ে কিভাবে একটা দেশের প্রসব যন্ত্রনার গল্প বলা যায় আমি জানি না। তারপরেও এতা এমন একটা উপন্যাস যার কথা বলতে সাধ হয়। পাঁচশতের বেশি পৃষ্ঠার এ উপন্যাস যেন মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসের এক খন্ডিত রুপ, যার মাধ্যমে লেখক সে সময়কে তুলে ধরতে চেয়েছেন। মাওলানা ইরতাজউদ্দিনকে দিয়ে তার সাথের মানুষজনকে, শাহেদকে দিয়ে সে সময়ের কোন স্বামীকে, গোরাঙ্গকে দিয়ে হিন্দুদের অবস্থাকে, নাইমুলকে দিয়ে এদেশের মুক্তিকামী যুবকদের, শাহ কলিমের মাধ্যমে সুবিধাভোগী, সার্থান্নেসী মানুশকে চিত্রিত করেছেন লেখক সুনিপুনভাবে। কত ঐতিহাসিক চরিত্র যেন সময়ের প্রয়োজনে এসেছে এই উপন্যাসে। কত ঐতিহাসিক সময় এসেছে এখানে। ৭ই মার্চের ভাষন, ২৫ শে মার্চের কালোরাত্রী, তারপর যুদ্ধ, অস্থায়ী সরকার গঠন, মাওলানা ভাষানী, তাজউদ্দিন, ইয়াহিয়া, জুলফিকার আলী ভুট্টো, নিক্সন, ইন্দ্রিরা গান্ধী; কে নেই এ উপন্যাসে! সবাই আছে। সবাইকেই যে থাকতে হবে। এটা যে উপন্যাস না, এটা যে একজন লেখকের দেশের প্রতি ঋণ শোধের চেষ্টা। এটা যেন পুরো বাংলাদেশের সে সময়কার গল্প। ঢাকার গল্প, নীলগঞ্জের মাধ্যমে গ্রামের গল্প, বরিশাল বা পিরোজপুরের মাধ্যমে নদীমাতৃক বাংলাদেশের গল্প, শরনার্থী শিবিরের গল্প, ভারতের কলকাতার গল্প, অস্থায়ী সরকারের গল্প। এটা যেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সাহসী যোদ্ধার গল্প, সুজোগসন্ধানী সুবিধাবাদীদের গল্প, কাপুরুষতার গল্প, বাবার গল্প, ভাইয়ের গল্প, বন্ধুর গল্প, শত্রুর গল্প, মায়ের গল্প, মেয়ের গল্প, বীরঙ্গনাদের গল্প, শহীদদের গল্প, গাজীদের গল্প; কারা নেই এখানে? উপন্যাসে বর্ণিত প্রায় সব ঘটনাই সত্যি। কিছু হুমায়ূন আহমেদের নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা যেটা আমরা উপন্যাসের মাঝে প্রায়ই দেখতে পাই। ইতিহাসের যে সময়টার তিনি বর্ণনা করেছেন সে সময় বা তার কাছাকাছি সময়ের তার ব্যাক্তিগত জীবনের ঘটনা প্রবাহ তিনি তখন তুলে ধরেছেন। কিছু অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে ধার নেয়া। যেটার নির্গঘন্ট বইয়ের শেষে হুমায়ূন আহমেদ দিয়ে দিয়েছেন। তিনি উপন্যাস প্রকাশের আগেই পান্ডুলিপিটা অনেককে পড়িয়েছেন। এই প্রজন্মের পাঠক, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি তাদের অনেকের কাছেই অনেক ঘটনা কাল্পনিক বলে মনে হয়েছে। তাদের জন্য হুমায়ূন আহমেদ একটা কথাই বলেছেন ‘সে বড় অদ্ভুত সময় ছিল। সপ্ন ও দুঃসপ্নের মিশ্র এক জগত। সবই বাস্তব, আবার সবই অবাস্তব।’ হুমায়ূন আহমেদ সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর সুররিয়েলিষ্টিক সময় পার করে এসে তার খানিকটা ধরতে চেয়েছিলেন এ প্রজন্মের জন্য যাতে তার মানবজীবন ধন্য হয়। ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ পড়ে মনে হয় তার অনেকটাই তিনি ধরতে পেরেছেন।
0 Responses to “জোছনা ও জননীর গল্প - হুমায়ূন আহমেদ”
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন