বুধবার, ১ জুলাই, ২০১৫

সন্ধ্যারাতের শেফালি (আত্মজীবনী) - আরতি দাস (অনুলিখন: শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়)

cover1

বহু দিন পরে বঙ্গরঙ্গমঞ্চে কোনও নায়িকা কলম ধরলেন, আত্মস্মৃতির লেখিকা হিসেবে যে মহামূল্যবান ‘সন্ধ্যারাতের শেফালি’টি মঞ্চ আলোকিত করে বসেছিলেন, তাঁর আদি নাম আরতি দাস। এক সময় রোটারি সভাগৃহ থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে চৌরঙ্গির ফারপো নামক তুলনাহীন রেস্তোরাঁয় মহানগরীর হৃদয়েশ্বরী হয়ে তিনি যে দীর্ঘস্থায়ী স্পন্দন তুলেছিলেন, জনসংখ্যার হিসেবে তার পুনরাবৃত্তি আর কোনও দিন হবে বলে মনে হয় না। সত্য কথা বলতে কী, সংখ্যাহীন আঘাত ও অপমানের ধারাবাহিক হেমলক বিষ পান করেও বিশ শতকের ক্যাবারে-রানি যে আজও দেহধারণ করে কলকাতা শহরেই বেঁচে রয়েছেন, সে খবরটাও নতুন প্রজন্মের নাগরিকদের কাছে অজানা হয়ে গিয়েছিল। রঙ্গমঞ্চের নটীদের ভাগ্য এই দুর্ভাগা দেশে এমনই হয়ে থাকে, নরম শরীরে যৌবনের আগুন জ্বালিয়ে তাঁরা দপ করে জ্বলে উঠে নগরবাসীদের ক্ষণকালের আনন্দ দেন, পানশালায় প্রবল উত্তেজনার সৃষ্টি হয়, কিন্তু দৃষ্টির নগদবিদায় ছাড়া আর কিছুই হয় না। এঁদের খ্যাতি তেমন দীর্ঘস্থায়ী হয় না। খেয়ালি ঈশ্বরও অন্ধকারের জোনাকিকে দীর্ঘজীবনের সৌভাগ্য দেন না। অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিস্মৃতির মেঘ এসে সব কিছু দুঃখ ঢেকে দেয়। আমাদের সৌভাগ্য, আমাদের নৈশ আনন্দে নৃত্য-সভার সম্রাজ্ঞী শেফালি পাদপ্রদীপের সামনে থেকে অদৃশ্য হলেও নির্মম নিষ্ঠুর জীবনের অগ্নিপরীক্ষার শেষে আজও কোনও রকমে বেঁচে আছেন। একদা যৌবন মদে মত্তা দেহটি ফারপো রেস্তোরাঁয় নৈশসভায় তার সব রহস্য রাতের পর রাত অনাবৃত করেছেন, তারপর পরিস্থিতির প্রয়োজনে অভিজাত মধুশালা থেকে নর্তকী শেফালি বঙ্গরঙ্গমঞ্চের ভিত্তিপ্রস্তর নড়িয়ে দিয়ে মহানগরীর নাট্যপ্রেমীদের হৃদয়েশ্বরী হয়ে উঠেছেন। তাঁর আত্মকথা আমাদের বাংলা সাহিত্যকে আরও বিষয়বৈচিত্রে সমৃদ্ধ করতে চলেছে। আমাদের সিনেমাজগৎ আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠলে অদূর ভবিষ্যতে সন্ধারাতের শেফালি একদিন চলচ্চিত্রের বিষয়ও হয়ে উঠবে। যা দেখে দেশবিদেশের মানুষ জানতে পারবে কেমন করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত এক বালিকা ভাগ্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে হৃদয়হীন এক মহানগরীর মনোমোহিনী হয়ে উঠেছিলেন, এই কৃতিত্ব বিনোদিনীর কৃতিত্ব থেকে কম নয়। বিদেশিনী হলে সায়েবরা তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র নিয়ে মিউজিয়াম বানাতেন। সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করতে-করতে নগর কলকাতার অনেক স্মরণীয় স্থানই গত পঞ্চাশ বছরে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে— পেলিতি ও ফারপো রেস্তোরাঁ এখন জীবিত মানুষদের স্মৃতিতেও বেঁচে নেই, বিশ্বরূপা থিয়েটার কোথায় ছিল, সারকারিনায় কবে শেফালিকে দেখার জন্য রায়ট বেঁধে যেত তা কারও মনে থাকবে না। মঞ্চে এসে সুবেশিনী কনি একে একে সব খুলে ফেলে শুধুমাত্র বিকিনি পরে নাচতেন। আমার পক্ষে নতুন অভিজ্ঞতা, রঙ্গমঞ্চের অন্ধকার দিক যা মনে করিয়ে দিত একশ বছরে বাংলার থিয়েটার পাড়ায় কিছুই পাল্টায়নি, বিশেষ করে কিছু মানুষের নিষ্ঠুরতা। বিখ্যাত হলেন ক্যাবারে নর্তকী শেফালি। প্রথম বাঙালি ক্যাবারে ডান্সার মিস শেফালি তাঁর আত্মজীবনী 'সন্ধ্যারাতের শেফালি'তে বলছেন, 'আমি জানতাম আমার শরীর সুন্দর৷ ...আমার বুক, আমার কোমর, হাত-পা, আমার কোমর-ছাপানো চুল, এমনকী আমার চাহনি, আমার হাসিও লোকের হার্টবিট বন্ধ করে দিত কয়েক সেকেন্ডের জন্য৷ রাতের কলকাতার হুল্লোড়কে এক লহমায় থামিয়ে দিতে পারতাম আমি৷ ...তবে আমি হোটলে ক্যাবারে করতাম ঠিকই, কিন্তু আমি না চাইলে কেউ আমার গায়ে হাত ছোঁয়াতে পারত না৷ সাফ কথা ছিল আমার যে, দেখছ দেখো৷ প্রাণ ভরে দেখো৷ আমার খোলা বুক, আমার খোলা পা, আমার কোমর, আমার নাভি, যতক্ষণ আমি ফ্লোরে আছি, দেখে যাও৷ কিন্তু ছুঁয়ে দেখার সাহস কোরো না৷ হাত বাড়িও না আমার দিকে৷ ...আমি বুঝেছিলাম শরীরটাই আমার একটা অ্যাসেট, যেটাকে সাবধানে, যত্ন করে রাখতে হবে৷' কল্পনা করতে অসুবিধে হয় না-যৌবন উপচানো 'ডিজাইনার' বিকিনি পরে ঘুরে ঘুরে নাচছেন মিস শেফালি৷ সেই শেফালি, যাঁকে শ্যুটিংয়ের প্রথম দিন গাড়িতে নিজে নিতে এসেছিলেন সত্যজিত্‍ রায়৷ নাচ আর তাঁর লাস্যের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে তামাম রইসি কলকাত্তা৷ শেফালির 'বিকিনি শরীর' উস্কে দিচ্ছে, কিন্তু ধরা দিচ্ছে না৷ একদিন ক্যাবারে নর্তকী শেফালিকে অভিনেত্রী-ডান্সারে উন্নীত করবে তা কে জানত? সব বাধা জয় করে সকলের চোেখের সামনে সীমাহীন সাফল্যের জয়মাল্য অর্জন করেছেন আমাদের শেফালি। যা অকল্পনীয় ছিল তাই ঘটেছিল সারকারিনা মঞ্চে—ভারতীয় নাটকের ইতিহাসে সে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা--একাদিক্রমে ১২০০ রজনীর অভিনয়! শেফালি বিজয়িনী হয়েছেন। এত দিন পরে জীবনসায়াহ্নে তিনি নিজের কথা লিখে ফেলার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। বিনোদিনীর আত্মকথার পর এমন দুঃসাহসিক সাহিত্য প্রচেষ্টা বাংলায় হয়নি।

ডাউনলোড করুন

Tags: ,

0 Responses to “সন্ধ্যারাতের শেফালি (আত্মজীবনী) - আরতি দাস (অনুলিখন: শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়)”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Contact

Subscribe

Donec sed odio dui. Duis mollis, est non commodo luctus, nisi erat porttitor ligula, eget lacinia odio. Duis mollis

© 2013 Ebook Craver. All rights reserved.
Designed by SpicyTricks