বৃহস্পতিবার, ১৮ জুন, ২০১৫
আ হিস্ট্রি অফ গড (স্রষ্টার ইতিবৃত্ত ) - ক্যারেন আর্মস্ট্রং (অনুবাদ - শওকত হোসেন)
'মিষ্টি ও তেতো যখন একসঙ্গে মিশে গেল, রঞ্জিত হয়নি কোনো তৃণ, স্রোতে কাদাময় হয়ে ওঠেনি জল; দেবতাগণ ছিলেন নামহীন-স্বভাবহীন-ভবিষ্যৎহীন।' দ্য বাবিলনিয়ান ক্রিয়েশন মানুষ যখন আধামানুষ-আধাপশুর স্তর উত্তীর্ণ হয়ে চোখ মেলল সজীব-সপ্রাণ আর ভয়ানক এই পৃথিবীর বুকে, আবিষ্কার করল তার অসহায়ত্বের দিকটি, তখন সে শুরু করেছিল দেব-দেবীর উপাসনা। আর দশটা শিল্পকলার মতোই রুদ্র প্রাকৃতিক শক্তিকে প্রসন্ন করার ইচ্ছায় সৃষ্টি করল ধর্ম। পরিণত হলো আধ্যাতিক জীবে। সেই আদি বিশ্বাস সুন্দর আর ভীতি জাগানো এক রূপ নিয়ে হলো মানুষের অভিজ্ঞতাজাত ও প্রকাশিত। এই দুঃখ-কষ্টময় জীবনেরও যে একটা মানে আছে, সেই মানের শিল্পসম্মত প্রকাশও হলো ধর্মের মধ্য দিয়েই। কিন্তু মানুষের সভ্যতার সাম্প্রতিক 'ধর্মনিরপেক্ষতা' একটি নতুন নিরীক্ষা। এই নিরীক্ষারই একটি প্রয়াস ক্যারেন আর্মস্ট্রংয়ের 'স্রষ্টার ইতিবৃত্ত' নামের বইটি। এই ভদ্রমহিলা প্রথম জীবনে রোমান ক্যাথলিক নান হিসেবে সাতটি বছর অতিবাহিত করার পর বৃত্তি ত্যাগ করে ডিগ্রি লাভ করেন অঙ্ফোর্ড থেকে। পড়ান লিও বায়েক কলেজে জুডিজম নিয়ে। 'অ্যাসোসিয়েশন অব মুসলিম সায়েন্স'-এর একজন সম্মানিত সদস্য। আর আজকের ব্রিটেনের ধর্মবিষয়ের প্রধান ব্যাখ্যাকারদের একজন তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে আছে 'মুহাম্মদ : এ বায়োগ্রাফি অব দ্য প্রফেট', 'ইসলাম : এ শর্ট হিস্ট্রি', 'হলি ওয়ার', 'ব্যাটল ফর গড', 'বুদ্ধ', এ কেস ফর দ্য গড' ইত্যাদি। তাঁর প্রধান কাজ মূলত ধর্মতত্ত্ব নিয়ে। সেই ধারারই সেমেটিক অঞ্চলের ঈশ্বর-অনুসন্ধানী গ্রন্থ এটি। এ কারণেই এর উপজীব্য হয়েছে ইহুদি, খ্রিস্টান এবং ইসলাম ধর্মীয় ঈশ্বরতত্ত্বের চার হাজার বছরের কালপর্বটি। সূচনা অংশেই লেখক জানান : "আমার যখন আট বছর, 'ঈশ্বর কী?' প্রশ্নের নিশ্ছিদ্র জবাব মুখস্থ করতে হয়েছিল আমাকে : 'ঈশ্বর হচ্ছেন পরমাত্মা, যাঁর কোনো অংশীদার নেই এবং যিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ।' এটা মোটেই বিস্ময়কর নয় যে, এই জবাব আমার কাছে খুব একটা অর্থপূর্ণ মনে হয়নি। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই জবাব এখনো আমাকে শীতল করে দেয়। একে সব সময়ই এককভাবে বিরস, অতিরঞ্জিত এবং উদ্ধত সংজ্ঞা মনে হয়েছে। অবশ্য এ বইটি লিখতে শুরু করার পর থেকে জবাবটিকে সঠিক নয় বলেও বিশ্বাস করতে শুরু করেছি।" আর তাই ঐতিহাসিক ও সমাজ-সাংস্কৃতিক অগ্রগতি এবং হাজার বছরের দার্শনিক পটভূমিতে বিভিন্ন পর্যায়ে কিভাবে একেশ্বরবাদী ধর্মগুলো ঈশ্বর সম্পর্কে খুব সূক্ষ্মভাবে ভিন্ন ধারণা গড়ে তোলে, সেই বিষয়টি বিশ্লেষণ করেন তিনি। পাশাপাশি সেসব ধারণার সাদৃশ্যের দিকেও মনোযোগ আকর্ষণ করেন। একেশ্বরবাদকে কেউ কেউ দেখেন অন্ধকার, নিঃসঙ্গতা ও আতঙ্ক হিসেবে, আবার কেউ দেখেন আলো আর দৈহিক রূপান্তর হিসেবে, যেন একই মুদ্রার দুই দিক। ক্যারেন এই গ্রন্থে আমাদের দেখান, ব্যাবিলনে নির্বাসনকালে প্যাগান দেবতাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইহুদিদের পূর্ণাঙ্গ একেশ্বরবাদী হয়ে ওঠার দিকটি, দেখান খ্রিস্টান ও মুসলমানদের সমান্তরাল অথচ আলাদা ধারণা ও বিশ্বাস সৃষ্টির প্রসঙ্গটিও। সেমেটিক অঞ্চলের একেশ্বরবাদী ধর্ম তিনটির স্রষ্টার স্বরূপ সন্ধানে লেখক তাঁর আলোচনার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছেন ধর্ম, দর্শন, সংস্কার ও বিজ্ঞান থেকে শুরু করে মনস্তত্ত্ব পর্যন্ত। ক্যারেন তাঁর সূক্ষ্ম গবেষণালব্ধ জ্ঞান থেকে উদ্ঘাটিত তথ্যগুলো উপস্থাপন করেন যুক্তি-শৃঙ্খলার পারম্পর্যে, সুখপাঠ্য-ভঙ্গিতেও। তাঁর বক্তব্য স্পষ্ট করার স্বার্থে তিনি অসংখ্য উদাহরণ দিয়েছেন পবিত্র কোরআন ও বাইবেল থেকে। বৈশ্বিক সেমিউলজিক্যাল আলোচনায় সেমেটিক অঞ্চলটি দখল করে আছে এক বিশেষ স্থান। এবার এই গ্রন্থ অনুবাদের জন্য ধন্যবাদ জানাই শওকত হোসেনকে। আমাদের ভাষা-সাহিত্যে হরবছরই প্রকাশিত হচ্ছে অনূদিত বই। তার মধ্যে বিশেষ গুরুত্ব পায় মূলত উপন্যাস আর ছোটগল্প। কবিতা, নাটক বা প্রবন্ধ কড় ধরে গোনা। এমন একটা সময়ে সেগুলোর বাইরে এসে এমন একটি বই ভাষান্তরের কাজ নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। প্রসঙ্গত জানাই, ক্যারেন আর্মস্ট্রংয়ের 'মুহাম্মদ : এ বায়োগ্রাফি অব দ্য প্রফেট', 'ইসলাম : এ শর্ট হিস্ট্রি', 'বুদ্ধ' এবং 'ব্যাটল ফর গড'-এরও অনুবাদক তিনি। আর দ্বিধাহীনভাবেই বলা যায়, যদিও এই অনুবাদকর্মে যৌগিক ও জটিল বাক্যের প্রাধান্য বেশ। তার পরও পড়া যায় সাবলীলভাবেই। বলা যায়, বাংলায় ধর্মতত্ত্ব বিষয়ের এই বইটির অনুবাদে তিনি মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।
0 Responses to “আ হিস্ট্রি অফ গড (স্রষ্টার ইতিবৃত্ত ) - ক্যারেন আর্মস্ট্রং (অনুবাদ - শওকত হোসেন)”
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন