শুক্রবার, ৮ মে, ২০১৫

তুষার - ওরহান পামুক (অনুবাদ শওকত হোসেন)

cover-1পামুক বেড়ে উঠেছেন মুসলিম-সংস্কৃতির মধ্যে। তিনি কখনো এই সংস্কৃতির ‘অপর’ হননি, একে নিজের বলেই জেনেছেন। ইস্তাম্বুল তাঁর নিজের শহর। এই শহরকে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের যোগসূত্র বললে খুব অত্যুক্তি হবে না। ফলে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যকে আলাদা সত্তা বলে ভাবার কোনো প্রয়োজন তাঁর হয়নি।
সংক্ষেপে বইটির বিষয়বস্তু জেনে নেওয়া যাক। উপন্যাসের গোড়াতেই আমরা জেনে ফেলি, বিশিষ্ট কবি কা জার্মানির ফ্রাংকফুটে এক যুগ নির্বাসন কাটানোর পর ফিরছেন নিজের শহরে, ইস্তাম্বুলে। তাঁর মা মারা গেছেন; তিনি এসেছেন মায়ের জানাজায় অংশ নিতে। ইস্তাম্বুলের একটি সংবাদপত্রের অ্যাসাইনমেন্ট পেয়ে তিনি চলে যাচ্ছেন কার্সে। সেখানকার পৌর নির্বাচন আর মেয়েদের আত্মহত্যা—দুই বিষয়ে অনুসন্ধান করবেন তিনি।
এসব ঘটনা ঘটছে নব্বইয়ের দশকের কার্স শহরে। পূর্ব আনাতোলিয়ার দুর্গম আর জীর্ণ এক শহর কার্স। একসময় যে অঞ্চলকে বলা হতো আর্মেনিয়া। কিন্তু সে জন্য এই শহরের খুব খ্যাতি অবশিষ্ট নেই। এখন এই শহরের খ্যাতি তুষারশুভ্রতার জন্য। তুর্কি ভাষায় ‘কার’ মানে তুষার। সেখান থেকেই কার্স।
কা এই শহরে আসছেন ঘন তুষারের মধ্যে। তাঁর আসাটা খুব খেয়াল করার মতো। কা ‘কারে’র (তুষারপাত) মধ্যে আসছেন কার্স শহরে। এরপর পামুকের সেই জাদুকরী ভাষায় আমরা মুখোমুখি হব চেনা একগুচ্ছ প্রসঙ্গের: রাষ্ট্র ইসলাম, সেক্যুলারিজম, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, নারীর পর্দা, আধুনিকতাবাদী সেনাবাহিনী আর একের পর এক আত্মহত্যা।
কা তাঁর অনুসন্ধান শুরু করেন। টার্কি সরকার মেয়েদের হেজাব পরা নিষিদ্ধ করেছে। স্কুল থেকে হেজাব পরা মেয়েদের অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর এসব অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করছে মেয়েরা। অবসন্ন পায়ে হেঁটে হেঁটে কা এসব আত্মহত্যাকারী নারীর পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকার নিতে থাকেন। তিনি বুঝতে পারেন, হেজাব পরতে বাধ্য করা বা না পরতে বাধ্য করা—দুই ঘটনারই ফলাফল অভিন্ন।
পাঠক দ্রুত জেনে ফেলেন, কা হেজাব নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন না হলেও ভেতরে ভেতরে ‘ফিদা’ হয়ে আছে আইপেকের জন্য। আইপেক ওর স্কুলের বান্ধবী। কিছুদিন হলো স্বামী মুহতারের সঙ্গে আইপেকের বিচ্ছেদ হয়েছে। কা আর আইপেক একদিন একটা পেস্ট্রি শপে যায় গল্প করবে বলে। সেখানেই খুন হন ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনের ডিরেক্টর নুরি ইলমায। এ সময় আততায়ীর সঙ্গে ইলমাযের কথোপকথন রেকর্ড হয়ে যায় গোপন রেকর্ডারে। এই কথোপকথন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আলাপটা মনোযোগ দিয়ে শুনলে বইটির সারবস্তু সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া সহজ।
এই ডিরেক্টর ক্লাসরুম থেকে হেজাব পরা মেয়েদের বের করে দিয়েছেন বলে নিন্দিত। কয়েকবার তিনি প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছেন। ঘাতক এসে খুবই ভদ্রভাবে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করে। একপর্যায়ে ঘাতক প্রশ্ন করছে:
‘…সুরা নূরের অপূর্ব ৩১ নম্বর আয়াত সম্পর্কে আপনার মতামত শোনা যাক।
—হ্যাঁ ঠিক। এই আয়াতটা খুবই পরিষ্কারভাবে মেয়েদের মাথা এবং মুখ ঢেকে রাখার কথা বলছে।
—অভিনন্দন স্যার! সোজাসাপ্টা জবাব। …আল্লাহর হুকুমের সঙ্গে ক্লাসরুমে হেজাব পরা মেয়েদের নিষিদ্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তটিকে কীভাবে মেলাচ্ছেন আপনি?
—আমরা একটা সেক্যুলার রাষ্ট্রে বাস করি। সেক্যুলার রাষ্ট্রই হেজাব পরা মেয়েদের নিষিদ্ধ করেছে।
—…রাষ্ট্রের আরোপ করা কোনো আইন কি আল্লাহর বিধান বাতিল করতে পারে?
—বেশ ভালো প্রশ্ন। কিন্তু সেক্যুলার রাষ্ট্রে দুটো ব্যাপার আলাদা।’
এরপর আততায়ী আরও কঠিন সওয়াল করছে:
‘…সেক্যুলার মানে কি খোদাহীনতা?
—না।
—তাহলে রাষ্ট্র যে এত এত মেয়েকে সেক্যুলারিজমের নামে ক্লাসরুম থেকে বের করে দিচ্ছে, সেটা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন, যেখানে ওরা স্রেফ ধর্মের বিধানই অনুসরণ করছে?’
ইলমাযের এই চিৎকারের মধ্যে আলোচনা থেমে যায় ‘শান্ত হও বাবা, আমার। থামো।’ কারণ, আততায়ী তখন গুলি চালিয়ে দিয়েছে। এই আলাপের মধ্যে উঠে আসা প্রশ্নগুলো আমাদের অচেনা নয়। কিন্তু তুষার উপন্যাসে এই সওয়াল-জবাবের তাৎপর্য এসেছে ভিন্নভাবে। পুরো বইটি পড়ে যাওয়া ছাড়া সেটা বুঝে নেওয়া অসম্ভব। হেজাব পরার অর্থ আমরা অনেকেই শুধু নারী স্বাধীনতার প্রেক্ষিত থেকে বুঝতে চাই, কিন্তু তুষার জানান দেয়, হেজাব না পরতে দেওয়ার আরও অনেক রকম অর্থ হয়।
বইটির অনুবাদে যত্ন আছে। কতটা সার্থক হলো, সেটা পাঠক ওপরের আলাপ থেকে আন্দাজ পাবেন। ভারী ভারী বিষয় নির্ভারভাবে তুলে ধরেছেন পামুক। আর বইতে তিনি পাঠকের জন্য রেখেছেন বুদ্ধির এক ক্ষুরধার থ্রিলার। আম-পাঠকও তাই বইটি পড়তে গিয়ে পিছু হটবে না।

ডাউনলোড লিঙ্ক

Tags: , ,

0 Responses to “তুষার - ওরহান পামুক (অনুবাদ শওকত হোসেন)”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Contact

Subscribe

Donec sed odio dui. Duis mollis, est non commodo luctus, nisi erat porttitor ligula, eget lacinia odio. Duis mollis

© 2013 Ebook Craver. All rights reserved.
Designed by SpicyTricks