মঙ্গলবার, ২৩ জুন, ২০১৫

প্রজা ও তন্ত্র - পার্থ চট্টোপাধ্যায়

IMG_00012আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রজাতন্ত্র কথাটির অর্থ দাঁড়ায়_প্রজাদের তন্ত্র। অর্থাৎ রাষ্ট্র প্রজাদের, এর শাসন ক্ষমতাও প্রজাদের। প্রজারাই রাষ্ট্র চালাবে। কথাটা কি ঠিক? রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, 'হ্যাঁ'। কারণ প্রজারাই তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে থাকেন। এই প্রতিনিধিরাই রাষ্ট্র চালান, মানে প্রজাই তো আদতে সব। কিন্তু প্রজা কথাটা থাকলে সেখানে রাজার কথা আসে। প্রজা থাকলে রাজা থাকে। আবার রাষ্ট্র যদি প্রজারা পরিচালনা করে থাকেন তাহলে প্রজা কারা, সবাই তো রাজা বা রাজা কারা, সবাই তো প্রজা। তাহলে প্রজাতন্ত্রের অর্থ কী দাঁড়ায়? এই গোলমেলে রাজনীতি নিয়েই নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদ পার্থ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন তাঁর 'প্রজা ও তন্ত্র' গ্রন্থটি। গ্রন্থটির প্রথম প্রবন্ধটিই প্রজা ও তন্ত্র। বিষয়টির গোলক ধাঁধা ছাড়াতে গিয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায় বাংলা অভিধান ঘেঁটে দেখেছেন বাংলা ভাষায় প্রজাতন্ত্র বলতে দুটি পৃথক রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বোঝায়। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধানে প্রজাতন্ত্র মানে 'প্রজাবর্গের সমানাধিকারবাদ; প্রজাদিগের পরামর্শনুসারে অথবা বিভিন্ন প্রজাবর্গের প্রতিনিধিদের ঐকমত্যানুসারে রাজ্যশাসন; উবসড়পৎধপু।' 'চলন্তিকা' অভিধানের পুরনো সংস্করণেও প্রজাতন্ত্রের অর্থ একই। কিন্তু সংসদ অভিধানের নতুন সংস্করণে দেখা যাচ্ছে, প্রজাতন্ত্রের অর্থ রূপান্তরিত হয়ে দাঁড়াচ্ছে_'প্রজাবর্গের নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা রাষ্ট্র শাসন বা শাসিত রাষ্ট্র জবঢ়ঁনষরপ। আসলে প্রজাতন্ত্র আর গণতন্ত্র যাই বলা হোক না কেন, সবই রাজতন্ত্রেরই একেক রূপ। জনগণের কারবার এখানে সামান্যই। সময় পাল্টালে রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্র এলেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই। রুশো বলেছিলেন, সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে মানুষ প্রত্যেকেই প্রত্যেকের অধিকার প্রত্যেকের কাছে অর্পণ করে, আর এতে কেউই তার অধিকার হারায় না। কেউ যদি তা লঙ্ঘন করে তাহলে চুক্তির কোনো কার্যকারিতা থাকে না। আধুনিক রাষ্ট্রে দেখব, তা গণতান্ত্রিক বা প্রজাতান্ত্রিক যে নামই হোক না কেন, রাষ্ট্রই প্রথম এ চুক্তি লঙ্ঘন করে। মানুষ রাজার কাছে বা রাষ্ট্রের কাছে তার অধিকার হস্তান্তর করে। কিন্তু জবাবে কী পায় সে, তার অধিকার কি রক্ষা হয়? রুশোর কথামতে এ চুক্তি তো তাহলে ভেঙে পড়ে। সেখানে আইন বা তা অমান্য বা রাষ্ট্রবিরোধিতার তো কোনো কথা থাকে না। রাষ্ট্র সেখানে প্রজাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বা আইন অমান্যের দায়ে বিচারের অধিকার হারায়। পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রজা ও তন্ত্র গ্রন্থটি সাজিয়েছেন আরো পাঁচটি প্রবন্ধ দিয়ে। এগুলো হলো 'মহাশান্তির পথে বিশ্ব', 'নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার ইতিহাস', 'রাবীন্দ্রিক নেশন কী', 'রাবীন্দ্রিক নেশন প্রসঙ্গে আরো দু-চার কথা' এবং 'নীতি, নেতা'। গ্রন্থের প্রত্যেকটি প্রবন্ধই গুরুত্বের দাবি রাখে।'সভ্য জাতি' ইউরোপের সঙ্গে যুদ্ধ কথাটা যেন জড়িয়েই থাকে। যেন সভ্যতার জন্য যুদ্ধের দরকারই। ইউরোপীয় কিছু তাত্তি্বক আগে এশিয়া ও আফ্রিকাকে 'আদার' হিসেবে দেখতেন, দেখতেন অস্পৃশ্য এবং সভ্যতাহীন জাতি হিসেবে। অ্যাডওয়ার্ড সাঈদসহ আরো অনেক তাত্তি্বক পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের এই 'আদারিং' বা অপর করাকে নাম দেন অরিয়েন্টালিজম। কিন্তু বর্তমানে পশ্চিমা তাত্তি্বকরা আবার বলতে শুরু করেছেন 'অপর' ধারণা। শুধু পাশ্চাত্যের নয়, এটা জন্মগত উত্তরাধিকার অর্থাৎ 'ইনহারেন্ট'। পাশ্চাত্যের এক তরুণ ইতিহাসবিদ নানা কসরত করে দেখিয়েছেন, পাশ্চাত্যের অনেক আগেই ভারতীয় উপমহাদেশে 'অপরায়ন' বা 'অ্যানুমারেশন' ছিল। তরুণ এই ইতিহাসবিদ এ জন্য পুরাতাত্তি্বক বিভিন্ন চিহ্নও হাজির করার চেষ্টা করেছেন। মহাশান্তির পথে বিশ্ব বলতে পার্থ চট্টোপাধ্যায় যেটা বোঝাতে চেয়েছেন তা হলো, দুই মহাযুদ্ধের পর পৃথিবীর যে বিশ্বায়ন ঘটেছে, তা পৃথিবীর জন্য কতটা মঙ্গলদায়ক হয়েছে বা হচ্ছে, আর কতটাই বা অমঙ্গলদায়ক হয়েছে, শান্তি পাচ্ছেইবা কতটুকু বিশ্ব। অনেকে বলেন, এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটছে বা ঘটবে। ইদানীং মানুষের মুখে আরেকটি কথাও শোনা যায়, বিশ্বায়নের ফলে মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিতে আমাদের ছেলেরা কাজ পাচ্ছে, স্যুট-টাই পরে তারা আন্তর্জাতিক হচ্ছে। তবে আমি আমার এমন এক প্রিয় মানুষকে চিনি, যিনি কি না মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিতে কাজ করে আন্তর্জাতিক হতে হতে নিজের মাকে মনে হয়েছে 'প্রভিন্সিয়াল'। মাকে তাঁর সঙ্গে বাস করার অযোগ্য মনে করে রেখে এসেছেন অজগাঁয়ে। তা হলে দেখুন বিশ্বায়ন তার থাবা কোন জায়গা পর্যন্ত নিয়ে গেছে। পার্থবাবু বিশ্বায়নকে তুলনা করেছেন দিলি্লকা লাড্ডুর সঙ্গে। খেলেও পস্তাবে, না খেলেও পস্তাবে। অর্থাৎ তোমাকে এ জোয়ারে গা না ভাসালেও অনেক ভুগবে_এ অবরোধ, সে অবরোধ, আরো কত কী? আর গা ভাসালে তো ডুববেই বটে। অতএব, এ বলয়, এ অর্থনৈতিক কাঠামো, ভাঙা ছাড়া কোনো উপায় নেই। নিম্নবর্গের ইতিহাস প্রবন্ধে পার্থ চট্টোপাধ্যায় ভারতীয় উপমহাদেশে ইতিহাস চর্চার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ 'নিম্নবর্গের ইতিহাস লেখার ইশতেহার ব্যাখ্যা করেছেন। রনজিত গুহ প্রথম ভারতীয় ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্য তত্ত্ব, এলিট জাতীয়বাদী ইতিহাসবিদ ও গোড়া মার্কসবাদী ইতিহাসবিদদের ইতিহাস চর্চার তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ভারতীয় ইতিহাস তৈরিতে তথা গোটা বিশ্বের ইতিহাস তৈরিতেই নিম্নবর্গের বড় ভূমিকা রয়েছে; সাম্রাজ্যবাদী ও জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদরা যা লুকাতে চান। তাই ইতিহাস চর্চার এ মনোভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। লিখতে হবে নিম্নবর্গের ইতিহাস, তাদের চৈতন্যের ইতিহাস। কোথা থেকে এল নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার প্রণোদনা বা শব্দটি এবং কী-ইবা করতে চান তাঁরা_এসবই বিস্তারিত এসেছে তাঁর এ প্রবন্ধে।সব মিলিয়ে বলা যায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের প্রজা ও তন্ত্র বইটি রাজনীতির নানা অধ্যায়ের এক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ, যা পাঠকের চিন্তাজগতের উত্তম খোরাক জোগাবে, পাশাপাশি নিয়ে যাবে রাজনীতির গভীর অধ্যয়নে।

ডাউনলোড করুন বইটি

Tags: , ,

0 Responses to “প্রজা ও তন্ত্র - পার্থ চট্টোপাধ্যায়”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Contact

Subscribe

Donec sed odio dui. Duis mollis, est non commodo luctus, nisi erat porttitor ligula, eget lacinia odio. Duis mollis

© 2013 Ebook Craver. All rights reserved.
Designed by SpicyTricks