বুধবার, ৩০ মার্চ, ২০১৬
সমনামী - ঝুম্পা লাহিড়ী । অনুবাদঃ পৌলোমী সেনগুপ্ত
ডাক্তারের বলে দেওয়া প্রসবের দিনের দু’সপ্তাহ আগে এক চিটচিটে বিকেলে অসীমা গাঙ্গুলি তার সেন্ট্রাল স্কোয়ার অ্যাপার্টমেন্টের রান্নাঘরে দাড়িয়ে একটা বাটিতে রাইস ক্রিম্পি, প্ল্যান্টার্স বাদাম আর কুচোনো লাল পেয়াজ একসঙ্গে মাখছিল। তাতে নুন, লেবুর রস আর মিহি করে কাটা কাঁচালঙ্কা মেশাতেই একটু সরষের তেলের জন্য তার মনটা হাহাকার করে উঠল। গর্ভবতী থাকার পুরো সময়টা অসীমা এই মাখার উপর ভরসা করেই কাটিয়েছে। তবে কলকাতার ফুটপাথে আর ভারতের সব রেল স্টেশনে কয়েক নয়া পয়সায় কাগজের ঠোঙায় ভরে যে ঝালমুড়ি বিক্রি হয়, তার তুলনায় অসীমার ক্রিম্পি মাখাটা নেহাতই জোলো। এমনকী এখনও, বাচ্চাটা বাড়তে বাড়তে তার ভিতরে আর একটুও খালি জায়গা না থাকা সত্ত্বেও, এই একটা জিনিসের প্রতি তার আকর্ষণ কমেনি। একমুঠো তুলে নিয়ে একটু মুখে দেয় অসীমা, তারপর ভুরু কোচকায়। প্রত্যেকবারের মতো এবারও একটা কিছুর অভাব রয়ে গেছে। সে শূন্যদৃষ্টিতে রান্নাঘরের কাউন্টারের উপরে পেরেক থেকে ঝুলতে থাকা তেল চিটচিটে রান্নার বাসনগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘাম মোছে। নকশাকাটা ধূসর লিনোলিয়ামের উপরে তার পা-দুটো টনটন করে ওঠে। তলপেটটা বাচ্চার ওজনে ভারী। সে একটা কাবার্ড খোলে। তাকগুলো হলুদ আর সাদা চেককাটা তেলতেলে কাগজে ঢাকা। কতদিন ভেবেছে কাগজটা পালটানো দরকার... । সে আর একটা পেয়াজ বের করে, উপরের ম্যাজেন্টা খোসাটা নখ দিয়ে টেনে তুলতে তুলতে সে আবার ভুরু কোঁচকায়। এক অদ্ভুত উষ্ণতা তার তলপেটে ছড়িয়ে পড়ছে, আর তার পরেই এমন একটা জোরালো টান যে সে নিচু হয়ে যেতে বাধ্য হয়, হা করে শ্বাস টানে। পেয়াজটা তার হাত থেকে ছিটকে মেঝেতে পড়ে যায়। যন্ত্রণার প্রথম প্রবাহ কেটে যায় বটে, তবে তার পরই আরও অস্বস্তিকর, আরও দীর্ঘস্থায়ী দ্বিতীয় প্রবাহ। বাথরুমে গিয়ে সে আবিষ্কার করে প্যান্টে খয়েরি রক্তের জমাট দাগ। তার স্বামী, এম আই টিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডক্টরাল ছাত্র অশোককে সে জোরে জোরে ডাকে। অশোক শোবার ঘরে পড়াশোনা করছে। পড়ার টেবিলটা আসলে একটা কার্ড টেবিল। লাল ও বেগুনি বাটিকের চাদর দিয়ে ঢাকা দুটো গদিই হল তাদের বিছানা, এখন সেটাই আবার অশোকের চেয়ার। অশোককে ডাকলেও অসীমা তার নাম নেয় না। সে কখনওই তার স্বামীর কথা ভাবার সময় তার নাম নিয়ে ভাবে না, যদিও সে ভাল করেই জানে নামটা কী। সে স্বামীর পদবি গ্রহণ করেছে বটে, কিন্তু সামাজিক নিয়মের খাতিরে সে কখনও স্বামীর নাম উচ্চারণ করে না। বাঙালি বউদের তা করতে নেই। হিন্দি সিনেমার চুমু বা আদরের মতো স্বামীর নামও খুব নিজস্ব, গহিন। এটা জোরে বলার কোনও প্রশ্নই নেই, কোনওভাবে এড়িয়ে যাওয়াই নিয়ম। তাই অশোকের নাম ধরে না ডেকে অসীমা শুধু বলে, “শুনছ?”
Tags: অনুবাদ উপন্যাস , অনুবাদ গ্রন্থ , উপন্যাস , ঝুম্পা লাহিড়ী
0 Responses to “সমনামী - ঝুম্পা লাহিড়ী । অনুবাদঃ পৌলোমী সেনগুপ্ত”
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন