মঙ্গলবার, ২৩ জুন, ২০১৫
চন্দ্রাবতীর রামায়ণ
চন্দ্রাবতীর বিস্ময়কর কাব্য-প্রতিভার পরিচয় মেলে তাঁর রচিত ‘দস্যু কেনারাম’, ‘মলুয়া পালা’ এবং ‘রামায়ণ’সহ অজস্র কবিতা ও লোক-সঙ্গীতের ছত্রে ছত্রে। তাঁর কবিতা সুরভিত বনফুলের মতো। চন্দ্রাবতী রচিত গ্রন্থাবলী তাঁকে বাংলা সাহিত্যের একটি উত্তুঙ্গ স্থানে পৌঁছে দিয়েছে যে স্থানটি কেড়ে নেওয়া অন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয়। বেদনা-বিধুর জীবন কাহিনীর জন্যেও চন্দ্রাবতী কিংবদন্তী হয়ে রয়েছেন।
কবি চন্দ্রাবতী বাংলা সাহিত্যের এক ট্র্যাজিক নায়িকা। রোম্যান্টিক মনের অধিকারী চন্দ্রাবতীর বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া প্রেমের বিয়োগান্তক ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় ‘চন্দ্রাবতী পালা’য়। ১২টি অধ্যায়ে ৩৫৪টি ছত্রের এ লোকগাথা চন্দ্রাবতীর জীবনীর তথ্যভিত্তিক একমাত্র লিখিত দলিল। নয়ানচাঁদ ঘোষের বর্ণনায় আছে, চন্দ্রাবতীর সঙ্গে বাল্যসখা জয়ানন্দের বন্ধুত্ব গভীর প্রেমে পরিণত হয়। সমর্পনের আশায় উদ্বেলিত চন্দ্রাবতী বলেন-
“তোমারে দেখিব আমি নয়ন ভরিয়া।
তোমারে লইব আমি হৃদয়ে তুলিয়া।
বাড়ির আগে ফুইট্যা রইছে মল্লিকা মালতী।
জন্মে জন্মে পাই যেন তোমার মত পতি”।
কী অসাধারণ আকুতি! সমকালীন সাহিত্যের প্রেম-পিয়াসী মানব-মানবীর ভাষা থেকে এ-ভাষার অবস্থান কি খুব দূরে?
নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে রামায়ণ রচনা করে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মূলে প্রথম কুঠারাঘাত করেন তিনি। সেই অর্থে চন্দ্রাবতী আমাদের সাহিত্যের প্রথম নারীবাদী কবি। বিষয়বস্তুর উপস্থাপনার গুণে চন্দ্রাবতীর এই রামায়ণ আমাদের চমকে দেয়। কারণ, তাঁর রচনায় সীতা-চরিত্রটি প্রাধান্য পেয়ে মূখ্য চরিত্রে পরিণত হয়েছে যার পাশে রাম চরিত্রটি পুরোপুরি ম্লান। সীতার মানসিকতাকে তিনি এক কালজয়ী চিন্তার আলোকে সুনিপুণভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, যেখানে নারী কেবল ব্যক্তি নয় ব্যক্তিত্ব! পুরাণের খোলস থেকে বের করে সীতাকে তিনি নবজন্ম রেজারেকশান দিয়েছেন। সীতা এখানে দেবী নন, মানবী। সীতা চরিত্র উপস্থাপনের এই নব-রীতি এবং নির্মানে আধুনিক ভাবনার মধ্য দিয়ে আমরা যে চন্দ্রাবতীকে পাই তিনি মূলতঃ নারীবাদের প্রবক্তা।
চন্দ্রাবতী রচিত রামায়ণের পান্ডুলিপিটি বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। অনাদি ভবিষ্যতের কোন অনুসন্ধিৎসু পাঠক হয়তো সেই প্রাচীন পান্ডুলিপিটি ঘেঁটে নবরূপে আবিষ্কার করবে বাংলা সাহিত্যের এই প্রথম নারী কবিকে। ততক্ষণ পর্যন্ত অভিবাদন এবং নিরন্তর শোভাযাত্রা অব্যাহত থাকুক এই নিঃসঙ্গ দ্রাবিড়ার প্রতি।
0 Responses to “চন্দ্রাবতীর রামায়ণ”
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন