বৃহস্পতিবার, ৯ জুলাই, ২০১৫
পূর্ববাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি - বদরুদ্দীন উমর (তিন খন্ড)
একমাত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বাদ দিলে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল ভাষা আন্দোলন একে বলা হয় আমাদের আত্মআবিষ্কার বা স্বরূপ-অন্বেষার সূচনালগ্ন। অনেকের মতে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ এই ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই উপ্ত ছিল। ভাষা আন্দোলনে গুরুত্ব বা মহত্ব কেবল ১৯৫২ এর ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকায় ছাত্রদের মিছিল-সংগ্রাম ও শহীদদের আত্মদানের ঘটনায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি নিয়ে তৎকালীন পূর্ব বাঙলার মানুষ কিংবা তার সচেতন অংশটির মধ্যে ১৯৪৮ কিংবা তারও আগে অর্থাৎ বিভাগপূর্বকালেই চিন্তাভাবনা শুরু হয় একথা যেমন সত্য, তেমনি বা তার চেয়েও বড় সত্য হল, এই আন্দোলনের তাৎপর্য ভাষা বা সাংস্কৃতিক স্বাধিকারের দাবি ছাড়িয়ে জাতীয় স্বাধীনতা ও মেহনতি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াইয়ের মধ্যে তার পরিণতি খুঁজেছিল। আপাতদৃষ্টে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বা নাগরিক সমাজের আন্দোলন বলে মনে হলেও ব্যাপক গণমানুষের ক্ষোভ-প্রতিবাদের জ্বালামুখ হিসেবে কাজ করেছিল সেদিন ভাষা আন্দোলনের ঘটনাটি। ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব বিচার কিংবা আমাদের জাতীয় জীবনে তার প্রভাব-প্রতিক্রিয়া বুঝতে হলে সুতরাং আন্দোলনের সামগ্রিক পটভূমি তথা সমকালীন রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটেই তা করতে হবে। আর এই অতি প্রয়োজনীয় কাজটিই বদরুদ্দীন উমর করেছেন তিন খণ্ডে সমাপ্ত এবং অজস্র সাক্ষাৎকার, দলিল সমৃদ্ধ তাঁর ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ গ্রন্থে। আমাদের জানা মতে ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে লেখা প্রথম গবেষণামূলক গ্রন্থ এটি। আর কোনো তর্ক বা প্রতিবাদের আশঙ্কা না করেই বোধ হয় বলা যায়, অদ্যাবধি কি তথ্য সমাবেশের কি বিশ্লেষণী ক্ষমতার দিক থেকে এই গ্রন্থটিকে অতিক্রম করার যোগ্যতা আর কারো হয়নি। কোনোরকম প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সম্পূর্ণ একক বা ব্যক্তি উদ্যোগে এ ধরনের বিশাল গবেষণাকর্মের উদাহরণ আমাদের দেশে আর দু-একটিও আছে কিনা সন্দেহ। ইংরেজিতে যাকে ‘মনুমেন্টাল ওয়ার্ক’ বলে লেখকের দীর্ঘ শ্রম এবং একনিষ্ঠ ও গভীর গবেষণার ফসল ভাষা আন্দোলনের এই প্রামাণ্য ইতিহাসটি সম্পর্কে অনায়াসে তা প্রয়োগ করা যায়। ১৯৭০ সালে, অর্থাৎ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঠিক প্রাকলগ্নে, এর প্রথম খণ্ডটি প্রকাশিত হতেই, লেখকের পূর্ববর্তী আরও কয়েকটি পুস্তকের মতোই, তা আমাদের চিন্তা চেতনাকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। আমাদের সমাজমানসে যার প্রভাব আজও কমবেশি কার্যকর।
বদরুদ্দীন উমর নানা দিক থেকেই আমাদের দেশের একজন ব্যতিক্রমী বুদ্ধিজীবী। বুদ্ধিজীবী কথাটাকে তার প্রকৃত বা সদার্থে বাংলাদেশে যে-অল্প কয়েকজন মানুষ সম্পর্কে ব্যবহার করা যায় নিঃসন্দেহে তিনি তাঁদের অন্যতম। তাঁর মত বা দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সহমত না হলেও একথা স্বীকার করতে কারোরই দ্বিধা হবার কথা নয়। সত্যি কথা বলতে কী, তিনি যদি আর কিছু নাও করতেন, শুধু তাঁর ভাষা আন্দোলনের এই ইতিহাস গ্রন্থটির জন্যই আমাদের বুদ্ধি ও মননচর্চার ইতিহাস স্মরণীয় হয়ে থাকতেন। যদিও এছাড়া আরও অনেক মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ তিনি করেছেন। উমরের মতে ইতিহাস ঘটনার বিবরণ মাত্র নয়, তার ব্যাখ্যাও। ফলে ঘটনাক্রমে বর্ণনা বা তথ্য জড়ো করতেই ইতিহাসকারের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। পণ্ডিত হিসেবেও তিনি ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী। একজন মার্কসবাদী হিসেবে তিনি মনে করেন কোনোকিছুই আসলে শ্রেণিনিরপেক্ষ নয়। ভাষা আন্দোলন, তার পটভূমি ও সমকালীন সমাজ-রাজনীতি বিচারেও স্বভাবতই তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে। কিন্তু এর ফলে ঐতিহাসিক সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা কোথাও ক্ষুণ্ন হয়নি। তথ্য সংস্থাপন কিংবা ব্যক্তির ভূমিকার উল্লেখ কোনো ব্যাপারেই তিনি যেমন অতিশয়োক্তি বা অতিশয্যপ্রিয়তার তেমনি খণ্ডদৃষ্টি বা একদেশদর্শিতার পরিচয় দেননি।
প্রথম খন্ড
দ্বিতীয় খন্ড
তৃতীয় খন্ড
0 Responses to “পূর্ববাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি - বদরুদ্দীন উমর (তিন খন্ড)”
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন